শ্যামবাজার পাঁচমাথার মোড়ে আজ আর বাসের জন্য দাঁড়ালাম না। অফিসের দেরি হয়ে গেছে। একটা খালি হলুদ ট্যাক্সি দেখতে পেয়ে বনহুগলী বলতে বলতে উঠে পড়লাম।
আজ মহালয়া। পুজো পুজো গন্ধটা কয়েক সপ্তাহ ধরেই ঘুরপাক খাচ্ছে শহর-জুড়ে। বড় বড় হোর্ডিং, কোন পুজো কোন মহানায়ক বা মহানায়িকা উদ্বোধন করবেন, কোন গয়না বা শাড়িটা এবছর না পরলে জীবনটাই ব্যর্থ, কম খরচে ফেসিয়াল কোথায় কোথায় করা যায় – ইত্যাদি ইত্যাদি।
ট্যাক্সি সবে টালা ব্রিজে উঠেছে। জ্যাম থাকায় ধীরে ধীরে এগোচ্ছে। কানে এল – রাস্তার ধারে চার তরুণ-তরুণী ও তিন প্রৌঢ়-প্রৌঢ়ার একটি দল পুজোর কোন দিন কী খাবে সেই নিয়ে আলোচনা করছে – কোন দিন চিকেন রেজালা, কোন দিন মটন চাপ এই সব আর কি।
এমন সময় ট্যাক্সির ড্রাইভার-দাদা হঠাৎ আমাকে বললেন – “আচ্ছা, আপনাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করবো?” আমি বললাম – “হ্যাঁ, বলুন।” দাদা বললেন – “বাঙালিরা যত পুজো-টুজো করে, তার মধ্যে দুর্গাপুজোকে তো সবচেয়ে বড়ো, সবচেয়ে শুভ মনে করে?” আমি বললাম – “তা তো বটেই।”
জ্যামটা একটু কেটেছে। গিয়ার বদলাতে বদলাতে সামনের দিকে তাকিয়েই উনি বলতে থাকলেন – “তাহলে এই শুভ অনুষ্ঠানের সময় এত মুরগি-ছাগল জবাই করে তাদের হাড়মজ্জা চেবানোর মতো পাপ কাজ করে কেন লোকজন?” বাঙালি জাতির সম্মানের দায় যেন নিজের কাঁধে নিয়েছি – এমন ভাবে বললাম, “আসলে দুর্গাপুজো তো বাঙালির কাছে ধর্মীয় উৎসব নয়, এটা একটা সামাজিক উৎসব। তাই ধর্ম-অধর্ম, পাপ-পুণ্য সেই বিচার বাঙালি করে না। যা খেলে, যা করলে, যা পরলে শরীরে ও মনে আনন্দ হয় – বাঙালি তাই করে থাকে।”
একটা টেম্পোকে ওভারটেক করতে করতে দাদা বললেন – “এটা কিন্তু ভুল বললেন। দুর্গাপুজো বাঙালিরা কিন্তু ধর্মীয় উৎসব হিসেবেই উদযাপন করে। যেকোনো ধর্মীয় উৎসবের একটা সামাজিক দিক থাকে, দুর্গাপুজোর ক্ষেত্রে সেটা না হয় একটু বেশী। কিন্তু দুর্গাপুজোয় প্রত্যেক মণ্ডপে প্রতিমার পুজো হয় তিথি-নক্ষত্র, নিয়ম-বিধি মেনে। পুজোর সব জিনিসপত্র আয়োজন করা হয় যত্ন সহকারে। শুধু ক্লাবে নয় – হাউসিং-এর পুজোগুলোও তো বেশ খুঁটি-নাটি নিয়ম মেনেই করা হয়। দুবেলা পুজোতে ভোগ লাগানো হয় ফলমূল, সন্দেশ, খিচুড়ি দিয়ে। সকাল হলে পাড়ায় অঞ্জলি দিতে ভিড় করে অনেকে – শ্রদ্ধার সঙ্গে প্রতিমার পায়ে ফুল দেয়। সবাই রোজ অঞ্জলি না দিলেও অষ্টমীর অঞ্জলি তো বাদ যায় না কিছুতেই। অথচ পুজো মণ্ডপের বাইরেই এগরোল, চিকেন-মটন বিক্রি হচ্ছে রমরমিয়ে । আবার পুজোর দিনে দুপুরে কোনও কোনও প্যান্ডেলের ভিতরেই পাত পেড়ে মাংস-ভাত খাওয়ার ব্যবস্থা! বাড়িতেও অষ্টমীর দিন চান করে শুদ্ধ হয়ে কাছের প্যান্ডেলে পুষ্পাঞ্জলি দিয়ে এসে কচি পাঠার মাংসে পেটপুজো। আমি তো কলকাতার বাইরেও অনেক জায়গায় গাড়ি চালিয়েছি। কোথাও এমনটা দেখিনি। পুজো ছাড়াও এমনিতেও সেখানকার মানুষ বাঙালিদের মতো এতো রাক্ষুসেপনা করে না। মহালয়া থেকে দশমী পর্যন্ত নব রাত্রি আর দশ দিন শুদ্ধ জীবনযাপন করে। যারা অন্যান্য সময় মাঝে সাঝে খাবার অনিয়ম করে থাকে, তারাও এই কদিন বিশুদ্ধ নিরামিষ খাবার খায় মায়ের প্রতি শ্রদ্ধায় ও ভক্তিতে। একমাত্র বাঙালিদেরই দেখি পুজোর নামে বেশী করে অবলা পশু-পাখীদের খুন-জখম করতে।”
আমার ফরোয়ার্ড ডিফেন্স নিমেষে ধুলিস্যাৎ হয়ে গেল। সত্যি তো – পুজো-পার্বন ও শুভ অনুষ্ঠানে বাঙালির অশুভ কাজকর্ম যেন কয়েক হাজার গুণ বেড়ে যায়! সরস্বতী পুজোর দিন জোড়া ঈলিশ, শিবরাত্রির দিন সিদ্ধি-ভাং তো লেগেই আছে। গৃহপ্রবেশের দিন একদিকে সত্যনারায়ণের পুজো, অন্যদিকে জ্যান্ত মাছ ধরে এনে হত্যালীলা। বিয়ের মতো একটা পবিত্র বৈদিক সংস্কারে একদিকে ভগবান বিষ্ণুর নামে যজ্ঞ, আর তার পাশেই অতিথি আপ্যায়নের নামে শত-সহস্র নিরীহ মাছ, মুরগি ও ছাগলদের নির্মম রক্তপাত ও খুন। কী করে সেখানে গুরুজনরা আশা করেন যে পাত্র-পাত্রীর জীবন সুখকর হবে? জন্মের পর অন্নপ্রাশন মানুষের জীবনে প্রথম শুভ অনুষ্ঠান। প্রসাদের সঙ্গে সঙ্গে শিশুটির মুখে শিশুটির মতোই অবোধ মাছকে মেরে তার মৃতদেহের অংশ ঠুসে দেওয়া হয়। কী মুখে আমরা প্রার্থনা করব যে সেই শিশুর ভবিষ্যৎ যেন সুন্দর হয়? কারও জন্মদিন উদযাপন মানে সেদিন অনেক বেচারি পশু-প্রাণীদের মৃত্যুদিন। এরকম জন্মদিনকে কি “শুভ” জন্মদিন বলা উচিৎ? সারা বছরই সন্তান বাড়ির বাইরে বেরোনোর সময় বাঙালি বাবা-মায়েরা দুহাত কপালে ঠেকিয়ে চোখ বন্ধ করে দুর্গা-দুর্গা বলে সন্তানের মঙ্গল কামনা করতে ছাড়ে না। কিন্তু কসাইকে সুপারি দিয়ে, মা দুর্গার দুর্বল গোবেচারা সন্তানদের নির্লজ্জভাবে খুন করিয়ে, নিজের হাত-মুখ-দাঁত দিয়ে সেই চরম অমঙ্গলের ফল নিজের শরীরে ঢুকিয়ে, আদৌ কি নিজের সন্তানের মঙ্গল কামনা করার অধিকার থাকে?
ভাবতে ভাবতে গলার কাছটা দলা পাকিয়ে উঠতে থাকল। একটা দম-বন্ধ করা অনুভূতি যেন কুরে কুরে খাচ্ছে আমাকে। হঠাৎ দেখলাম গন্তব্য এসে গেছে। হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম যেন। টাকা দিয়ে নামতে যাচ্ছি, এমন সময় দাদা বললেন – “আমিও বাঙালি, কিন্তু আপনাদের মতো অতো শিক্ষা-দীক্ষা নেই। তাই বাঙালি এরকম কাজ কেন করে, আপনাকে জিজ্ঞেস করলাম।” আমি একরাশ গ্লানি মেখে কিছু না বলে মাথা হেঁট করে অফিসে পালিয়ে গেলাম তাড়াতাড়ি।
বাড়ি ফেরার পথে “বাবা লোকনাথ চিকেন সেন্টার” আর “মা তাঁরা চিকেন শপ”-এ লম্বা লাইন দেখে স্বগতোক্তি করলাম – “জীবে প্রেম করে যেই জন, সেই জন সেবিছে ঈশ্বর।”